জাতীয় শিক্ষা বলতে সেই
শিক্ষাকে বোঝায়, যে শিক্ষায় সকলের সমানাধিকার থাকবে, যে শিক্ষা জাতির রীতিনীতি,
আচার-ব্যবহার,মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করে জাতির জীবনরস পুষ্ট করবে
এবং সুদীর্ঘকাল ধরে জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় সাহায্য করবে। এই আদর্শ ও নীতির উপর
ভিত্তি করে বিংশ শতকের প্রথম দিকে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষাক্ষেত্রে
যে পরিবর্তন আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল, তাকেই জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন বলে।
জাতীয়
শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ঃ ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের ফলে ভারতের শিক্ষা
ব্যবস্থাও চলতে থাকে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থের অনুকুলে । ইংরেজ প্রবর্তিত
শিক্ষার সঙ্গে দেশের নাড়ীর কোন সম্পর্ক ছিল না। জাতীয় নেতৃবৃন্দ ইংরেজ প্রবর্তিত
এই শিক্ষা ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন, এবং দ্রুত জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা
ঘটল। ১৯০১ সালে রবিন্দ্রনাথ বোলপুরে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামে আবাসিক বিদ্যালয় এবং
১৯০৩ সালে প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ঈঙ্গ-বৈদিক কলেজ
স্থাপন করেন। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের গতি সঞ্চার করেছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন।বঙ্গভঙ্গের
বিরুদ্ধে বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রদের যোগদান বন্ধ করার উদ্দেশে সরকার
কার্লাইল সার্কুলার জারি করে। ছাত্র নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ার রংপুরে প্রথম জাতীয়
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৫ সালে। ১৯০৬ সালে কলকাতায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।
সম্পূর্ণ জাতীয় আদর্শে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ৯২ জন সদস্যকে নিয়ে এই পরিষদ গঠিত হয়। এই
বছরই সতীশচন্দ্রের ডন সোসাইটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সঙ্গে মিশে যায়।জাতীয় শিক্ষা
পরিষদ জাতীয় স্কুল ও কলেজ স্থাপন করে। বিদ্যালয় স্তর থেকে আরম্ভ করে, উচ্চ শিক্ষা
পর্যন্ত এক ব্যাপক ও বহুমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিল জাতীয় শিক্ষা পরিষদ।
কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নের জন্য ১৯০৬ সালে
তারকনাথ পালিত কারিগরি শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। রাসবিহারী ঘোষ ছিলেন
এর সভাপতি। সমিতি ওই বছরই কলকাতায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট স্থাপন করে।
জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সময়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে
বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করার উদ্দেশে গোখলের ১৯১০ সালে এবং ১৯১১ সালে পর পর দুটি
শিক্ষা বিল “রজকীয় আইন পরিষদে’ উপস্থাপন করেন। কিন্ত সরকারের উদাসীনতায় এগুলি
কার্যকর হয়নি।
জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের
ফলে পূর্ববঙ্গে ৪০টি এবং পশ্চিমবঙ্গে ১১টি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী
সময়ে তিলক বোম্বাইতে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । এছাড়া মাদ্রাজ ও
অন্ধ্রপ্রদেশে অনুরুপ বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে জাতীয় শিক্ষা
আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।